সর্বশেষ

6/recent/ticker-posts

দেশে করোনা মোকাবিলায় গবেষণা কম


 করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে এবং রোগীর চিকিৎসায় গবেষণার তথ্য কাজে লাগাতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। মূল দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো গবেষণার তথ্য দিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে সহায়তা করতে পারেনি। দেশের প্রধান প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ও মহামারি নিয়ে গবেষণায় পিছিয়ে আছে।

বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি সে তুলনায় এগিয়ে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পর্বের শিক্ষার্থীদের একটি সংগঠনের বেশ কিছু গবেষণা ইতিমধ্যে বিদেশি চিকিৎসাবিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। এসব গবেষণার ফলাফল সরকারের কাছে পৌঁছায় কি না, পৌঁছালেও নীতিনির্ধারকদের কাছে তা কতটা গুরুত্ব পায়, তা নিয়ে অনেকেরই সংশয় আছে।

করোনা মহামারি বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এর প্রভাব শুধু স্বাস্থ্য, চিকিৎসা বা হাসপাতালের ওপর পড়েনি; প্রভাব পড়েছে সমাজ ও ব্যক্তির ওপর, ব্যবসা-বাণিজ্য-অর্থনীতির ওপর, এমনকি বিদেশনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপরও এর প্রভাব পড়েছে। শিশু থেকে বৃদ্ধ—সব বয়সী মানুষ করোনা পরিস্থিতির শিকার। নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর এর প্রভাব ভিন্ন ধরনের। করোনা নিরাময়ে সুনির্দিষ্ট ওষুধ নেই। টিকা উদ্ভাবনের কাজ চলছে।

মহামারি ও করোনাভাইরাস–সংশ্লিষ্ট এসব বিষয় নিয়ে বিশ্বজুড়ে গবেষণা চলছে। বলা যায়, গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে নতুন ভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পরপরই গবেষকেরা কাজে নেমে পড়েন। নতুন তথ্য-উপাত্ত ও বিশ্লেষণ জানার জন্য সাধারণ মানুষ, সাংবাদিক, নীতিনির্ধারক ও রাজনীতিকদের উন্মুখ হতে দেখা গেছে। এসব তথ্য মহামারি নিয়ন্ত্রণ, রোগীর চিকিৎসা ও জনদুর্ভোগ কমাতে কাজে লাগিয়েছে বিভিন্ন দেশ। করোনা–পরবর্তী জীবন কেমন হতে পারে, তা নিয়েও বড় বড় প্রতিষ্ঠান গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষেরও করোনা বিষয়ে নতুন তথ্য জানার ব্যাপক আগ্রহ আছে।

অনেকে মনে করেন, করোনা বিষয়ে বৈশ্বিক পর্যায়ে যে পরিমাণ গবেষণা, জরিপ বা সমীক্ষা হয়েছে ও হচ্ছে, তার তুলনায় বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। জনস্বাস্থ্যবিদ ও ব্র্যাকের সাবেক ভাইস চেয়ার আহমেদ মোশতাক রাজা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, দেশের মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। কেন মানছে না, তা জানা সম্ভব গবেষণা থেকে। কত মানুষ সংক্রমিত, তা–ও জানা সম্ভব। কিন্তু এসব বিষয়ে গবেষণার তথ্য জানাতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যর্থ হয়েছে।

এখনো গবেষণাই করছে

দেশে রোগের ওপর নজরদারি ও রোগ নিয়ে গবেষণা করার দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর)। প্রতিষ্ঠানটি করোনা নিয়ে দিনের পর দিন প্রেস ব্রিফিং করেছে, করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা করেছে। প্রতিষ্ঠানটি বেশ আগে থেকে একাধিক গবেষণা শুরু করেছে। তবে কোনো গবেষণা এখনো শেষ করতে পারেনি।

দেশে করোনার সংক্রমণের সপ্তম মাস চলছে। আইইডিসিআর থেকে সংগ্রহ করা করোনাবিষয়ক গবেষণার তালিকায় দেখা যায়, ৮টি গবেষণা চলমান আছে। এর বাইরে তিনটি গবেষণা প্রকল্প তারা জমা দিয়েছে, এখন অর্থায়নের জন্য অপেক্ষা করছে। এ ছাড়া দুটি গবেষণা প্রকল্প পর্যালোচনার পর্যায়ে রয়েছে। একটি প্রকল্প তৈরির কাজ চলছে। কাজ শুরু না হলেও একটি প্রকল্পের অর্থায়ন নিশ্চিত হয়েছে।

চলমান গবেষণাগুলোর একটি স্বাস্থ্যকর্মীদের (চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্য সহকারী) করোনার ঝুঁকির কারণ নির্ণয় করা। অন্য একটি গবেষণা চলছে শুধু চিকিৎসকদের ঝুঁকির কারণ নির্ণয় করা। এই গবেষণা ফলাফল কবে প্রকাশ করা হবে এবং সেই ফলাফল চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা দিতে কী কাজে লাগবে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে, ইতিমধ্যে করোনায় ৮৮ জন চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে।

আইইডিসিআর দেশে করোনা সংক্রমণের বাস্তব পরিস্থিতি জানতে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) সঙ্গে যুক্ত থেকে ঢাকা শহরে জরিপ করেছে। এতে সহায়তা করেছে যুক্তরাষ্ট্রের দাতা সংস্থা ইউএসএআইডি। প্রায় এক মাস আগে তথ্যের প্রাথমিক বিশ্লেষণ চূড়ান্ত করা হলেও তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি।

এসব বিষয়ে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে তিনটি গবেষণা ফলাফল চূড়ান্ত করেছি। দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে এগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে।’

রোগ নিয়ে গবেষণা করে সরকারের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিভেনটিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিন (নিপসম)। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক অধ্যাপক বায়জিদ খুরশিদ রিয়াজ জানিয়েছেন, করোনা বিষয়ে তিনটি গবেষণা চলছে। এর একটি চূড়ান্ত হয়েছে। ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি। তবে ফলাফল নিয়ে একটি প্রবন্ধ যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নাল অব এপিডেমিওলজি অ্যান্ড ইনফেকশন–এ প্রকাশ করার জন্য জমা দেওয়া হয়েছে।

জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট) জনসংখ্যা, মাতৃস্বাস্থ্য, শিশুস্বাস্থ্য, হাসপাতালে সেবা পরিস্থিতি নিয়ে জাতীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ জরিপ করে আসছে কয়েক দশক ধরে। এই প্রতিষ্ঠানও করোনা পরিস্থিতি নিয়ে কোনো জরিপ বা গবেষণা করেনি। প্রতিষ্ঠানের একজন শীর্ষ স্থানীয় কর্মকর্তা বলেছেন, মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যের ওপর করোনার প্রভাব নিয়ে একটি জাতীয় জরিপ করার পরিকল্পনা তাঁদের আছে।

সরকারের এই তিনটি প্রতিষ্ঠান করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য দিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে সহায়তা করতে পারেনি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর দুটি জরিপ করেছে। রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল করোনায় আক্রান্ত হয়ে ২০৯টি মৃত্যুর ঘটনা পর্যালোচনা করেছে। এ নিয়ে সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি। তবে বেসরকারি একটি হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালের চিকিৎসকেরা করোনা শনাক্ত করতে সিটি স্ক্যান ব্যবহারের নিয়ে একটি গবেষণা করেছিলেন। সেই ফলাফল ভারতভিত্তিক গবেষণা সাময়িকী স্কলার্স জার্নাল অব অ্যাপ্লায়েড মেডিকেল সায়েন্স–এ ছাপা হয়।

Post a Comment

0 Comments